শুরু বাজে খবর আগডুম বাগডুম দুষ্টুমি সিনেমাস্তি গালগপ্পো ক্লাসরুম অন্যান্য যোগাযোগ নাটকের দল নিয়ে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা। কিছু জমানো ক্ষোভ অভিমান দুঃক্ষ, চাপা রাগ।
পরিবর্তনের জমানায় যখন চারিদিকে নাট্যকর্মীদের প্রত্যক্ষ ভুমিকা লক্ষ্য করেছিলাম ভেবেছিলাম তারা হয়ত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নাটকের জন্যে বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় কিছু করবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ কিছু করেনি। কিছু করেনি বলাটা ঠিক হল না হয়ত, তবে আমার চোখে কিছু পড়েনি। যেমন দমদমে কোনো মুক্ত নাটকের জায়গার ব্যবস্থা নেই। কোনো নাটকের হলও নেই। না আছে, দু-একটা। পাইকপাড়ায় একটা মোহিত মঞ্চ নতুন করে সাজানো হল, দমদমে রবীন্দ্রভবন হল।
কিন্তু এগুলো সবই বড় গাছেদের জন্যে। সেখানে বছরে দু-বার নাটকের সপ্তাহ ছাড়া আর সেরকম কিছু হয় না। কোনো দল এখানে নিয়মিত নাটক করে না। জানি না তাহলে সারা বছর সেখানে কি হয়। বাইরের বিশাল প্যাসেজে কন্যাশ্রী প্রকল্পের হাজার খানেক সাইকেল ডাঁই করে রাখা আর এদিক ওদিক মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা তোলার গাড়ি গুলি গ্যারেজ করা থাকে।
আচ্ছা নাটকের জন্যেই যদি এই মঞ্চের নির্মাণ তাহলে ছোটদলগুলিকে সেখানে কি প্রবেশ করতে দেওয়া হয় ?? শুধু শো করার কথা বলছি না। আমি ২০০৬ সাল নাগাদ কিছু বন্ধু মিলে একটা নাটকের গ্রুপ শুরু করেছিলাম ৮টা ১০টা শো-ও করেছি কিন্তু আমাদের সবথেকে বড় অসুবিধা ছিল রিহার্সালের জায়গা। এখানে কি কাউকে সামান্য খরচে রিহার্সালের জন্যে বা শো করতে দেওয়া হয়। হয়ত ৫ কি ৭ হাজার টাকা ভাড়া নেওয়া হয় (সঠিক জানি না), কিন্তু ভাড়া নেওয়া কি জরুরী ?? কারণ সকলেই জানে এখানে নাটক দেখতে কেউ আসবে না। তার জন্যে চাই প্রচার, সেটা করতেও আবার টাকা লাগে। এবার একটা নাটকের দল এত টাকা পাবে কোথায় ?? হল ভাড়া, প্রচার, এবং একটা ভালো প্রোডাকশান করতেও তো কিছু টাকার দরকার। নিন্দুকেরা বলতেই পারে, নাটক করতে এয়েচ কেন বাওয়া।
আমাদের নিজেদের গ্রুপে, আমরা যারা ছিলাম তাদের কারো বাড়িতেই এত বড় জায়গা ছিল না যে রিহার্সাল দেওয়া যায়। আমরা প্রথমে কিছু দিন একজনের ছাদে, তারপর কিছুদিন একটা ক্লাবে এবং আরো কিছুদিন পর একটা প্রাইমারি স্কুলে রিহার্সাল দিতাম। এগুলো পেতেও অনেক কাঠখড় পোঁয়াতে হয়েছিল। যাই হোক, আমরা কোনো সায়ক বা নান্দীকার বা নিদেনপক্ষে বকুলতলা ব্রাত্যজন ছিলাম না ( প্রসঙ্গত শুনেছি অমুক ব্রাত্যজন বা তমুক ব্রাত্যজন নামে কলকাতায় ১০টার বেশী দল আছে)। এছাড়া আমরা কোনো বড় ব্যাক্তিকে খুশী করার তাগিদে তার লেখা নাটক করতাম না, নিজদের সামর্থ্য অনুযায়ী নাটক নিজেরাই লিখে নিতাম। আমাদের লোকবল অর্থবল বেশী ছিল না। ধীরে ধীরে কিছু শো পাচ্ছিলাম এবং সেগুলির বেশীর ভাগই বিনে পয়সায়, নিজের পয়সায় যাতায়াত করতে হত, টিফিন আর বসার জন্যে চেয়ার ছাড়া আর কিছুই মিলত না। তবু শেষ অবধি দলটা বন্ধ হয়ে গেল। এবং এর একটাই কারণ রিহার্সালের জায়গা।
আজ দমদমে বহু ছোট বড় মেজো সেজো দল রয়েছে, তারাও নিশ্চয় একটা সঠিক রিহার্সালের জায়গার অভাবে ভোগে কিন্তু তারা যে যারটা কোনো মতে খুঁজে নিয়ে ঠেকা দিয়ে তাপ্পি দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে। এরা সকলে মিলিত হয়ে একটা কমন প্লেসের সন্ধান করছে না কেন ? এদের মধ্যে বহু নাটকের দলেই এমন ব্যক্তিও আছেন যারা বেশ নাম ডাকওয়ালা। দু-একজনকে বললেই হয়ত জায়গা নিয়ে সমাধান করে ফেলেন। কিন্তু এতে তার নিজের একার সমাধান হয়, গোটা নাটকজাতির সমাধান হয় না।
তাই নতুন নাটকের দল খোলাটা এখন খুবই দুরুহ, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, সকলেই নতুন দল খোলার চেয়ে কোনো উঠতি দলে নিজের নাম লিখিয়ে নিতে বেশী পছন্দ করছে। কিন্তু সকলেই তো আর অন্যের চিন্তায় সমপন্থী হতে পারে না। প্রচুর এমন মানুষ আছে যারা নাটকের মাধ্যমে নতুন কিছু বা অন্য কথা বলতে চায়। আর যে কোনো সংগঠন যত পুরোনো হয় তত তার মেরুদন্ড দুর্বল হতে শুরু করে। প্রতিবাদ তেমন সোচ্চার হয় না, বিক্ষোভে সেরকম আগুন থাকে না, হাসিতে প্রাণ থাকে না। পুরোটাই অভ্যাসে পরিণত হয়।
আমার মনে হয় বিভিন্ন অঞ্চলের নাট্যদলগুলির মধ্যে একটা একতা থাকা প্রয়োজন এবং একই অঞ্চলের নাটকের দলগুলিকে একটা ফোরাম বা ঐ গোছের একটা বানিয়ে নিয়মিত বসা খুব দরকার। এবং কমন সমস্যাগুলি একসাথে সমাধান করার প্রচেষ্টা করার প্রয়োজন। বড় দল গুলি এতে অংশগ্রহণ করতে চাইবে না, বা না চাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ছোট দলগুলিকেই মিলিত হতে হবে।
কেউ নতুন দল করলে তাকে উৎসাহ দিতে হবে। আমি আর আমার বন্ধু যখন নতুন দল খুলি তখন পুরোনো দলের মাথারা আমাদের এমন ভাবে দেখেছিল যেন আমরা দেশভাগ করে ফেলেছি। আরে বাবা !! তোমার আমার তো কোনো বিরোধ নেই, তুমি যেমন করছ তেমন কর, আমাকে আমারটা করতে দেবে না ???? এরকমটা নাটক বা ব্যান্ডের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, প্রথম দল মনে করে এই রে ওরা বোধহয় আমার দলটা ভাঙ্গবে !!! কিন্তু একটা কিছু না ভেঙ্গেও অন্য একটা তৈরী করা যায়।
কোনো দলের কিছু সদস্য যখন অন্য দল তৈরী করে, এবং নানান প্রতিকুলতায় সেটা ভেঙ্গে যায় তখন প্রথম দল হেব্বী খুশী হয়। জানতাম পারবে না, সকলের দ্বারা কি সব হয় ইত্যাদি ভাব দেখায়। অদ্ভুত না ?? একটা নাটকের দল ভেঙ্গে গেলে আর একটা নাটকের দল খুশী হয়। আর আমি বলছি এদের মধ্যে মেলবন্ধনের কথা!! তবে এরকমটা যে হয় নি এমন নয়। শুনেছি বীরভুমে আছে, দত্তপুকুরেও এরকম ফোরাম আছে, যেখানে সকল নাট্যদলগুলি একসাথে বসে এবং সামগ্রিক ভাবে নিজেদের (যেটা কিনা নাটকেরও বটে) সমস্যার সমাধানের পথ মিলিত ভাবে খুঁজে বার করার চেষ্টা করে।
আমার মাঝে মাঝে এখনও প্রবল ইচ্ছে হয়, কিছু লোক জড়ো করে একটা দারুণ নাটক করি। কিন্তু সম্ভবত সম্ভব হবে না বলে পিছিয়ে আসি। এখন শুনেছি এক একটা হল ভাড়া করতে ১০ / ১২ হাজার লাগে। এছাড়া লাইট। কস্টিউম। মেকাপ। মিউজিক। সেট নিয়ে হয়ত আরো ১৫ হাজার লেগে যায়। অর্থাৎ প্রতি শো পিছু ২০ হাজার মিনিমাম। ঐ একই টাকায় আমি একটা ভালো শর্টফিল্ম বানিয়ে ফেলতে পারি এবং নানান উপায়ে সেই শর্টফিল্মের দর্শকের কোনো অভাব হয় না। এছাড়া ব্যবহারিক প্রয়োগটাও খুব লম্বা। একবার বানিয়ে ফেলতে পারলেই হল। দ্বিতীয়বারের চিন্তা করতে হয় না। একটা দশটাকার ডিভিডিতেই সেটা সারা জীবন বন্দী করে রাখা যায়। যখন ইচ্ছে দেখা বা দেখানো যায়। তবু শহরের দামী ফ্লাটে দিনযাপন করা মানুষকে ছোটবেলার গ্রাম যেভাবে হাতছানি দেয়, নাটক আমাকে সেভাবেই আকর্ষণ করে। আজও।
No comments
Post a Comment