গর্ভপাত
সন্তান না হওয়ার কারণে একের পর এক ওষুধ প্রয়োগ চলছিলো নীলিমার উপর। চব্বিশ বছর বয়সে রতনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নীলিমার। সন্তান না হওয়ার জন্য সাঁইত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে চার বার অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করতে হয়েছে নীলিমাকে। তবু বিধাতা তার দিকে মুখ তুলে তাকায় নি। শেষ যেবার অপারেশন করা হয়েছিল তখন ডাক্তার বলেছিলেন পূর্বের কোনো ভুল অপারেশন কিংবা ওষুধের ফলে একটা ওভারি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনে তারা নিরাশ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু যেখানে কোনো ডাক্তারের নাম শুনতো সেখানেই ছুটে যেত।
এত প্রচেষ্টা আর দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো ফল হলো না। শেষ অপেরাশনের পরে দুই বছর না যেতেই নীলিমার ক্যানসার ধরা পড়ে। ক্রমাগত অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণের ফলে তার ইউটেরাসে ক্যানসার হয়েছিল। পরে সে ব্লাড ক্যানসারে মারা যায়। চল্লিশ বছর বয়সে রতন দ্বিতীয় বিয়ে করে। দ্বিতীয় বিয়ের পরেও আঁট বছর অতিক্রম করেছে এখনও তাদের কোনো সন্তান হয় নি। এখন রতনের বয়স প্রায় আটচল্লিশ । তার স্ত্রীর বয়সও বিয়াল্লিশ। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে রতন জীবনের প্রথম নিজের উপর টেস্ট করেছিল। তখন সে জানতে পারে অতিরিক্ত আ্যলকোহল গ্রহণ এবং ধূমপানের ফলে তার স্পার্ম কাউন্ট কমে গিয়েছিল অনেক কম বয়সেই। সে কারণেই সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা হয়ে ওঠে নি রতনের।
সেদিন সন্ধ্যায় নির্জন বাড়ির বারান্দায় বসে পুরোনো আ্যলবাম ঘাটছিলো রতন । নীলিমার হাসি মুখটিকে দেখে বিষণ্ণতায় ভরে ওঠে তার মন। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল তার। ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটি অকারণ ভুল চিকিৎসায় মারা গেল। এমন সময় পাশের বাড়ির শুভজিতের মা বড্ডো অবজ্ঞার সুরে বলে উঠলো "ও....., মেয়ে হয়েছে! আমরা সবাই কত আশা করলাম কাকলীর ছেলে হবে। কী আর করা যাবে ? ফেলে তো দেওয়া যাবে না। যা হয়েছে মানুষ করুক"। কাকলী শুভজিতের পিসি, অর্থাৎ শুভজিতের মায়ের ননদ। কথাটা শুনে চমকে উঠল রতনে। রতনের ইচ্ছা হচ্ছিল তখনই ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলতে "ওরাও তো মানুষ। ওদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে। যার পেটে জন্মায় সেওতো নারী। নিজের মা, বোন, দিদি, মাসি, পিসি, কাকিমা, জেঠিমা, বউদি, স্ত্রী - এরা সকলেই তো নারী। এদের নিয়ে তোমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে কেন, যে কন্যা সন্তান আজ ভুমিষ্ট হলো তাকে নিয়ে এত অবহেলা আর বিতৃষ্ণা ? যে আজ জন্মেছে ভবিষতে সেও একদিন ওই জায়গাগুলোতে পৌঁছাবে। ওই নব শিশুটিও সমাজের একটি অংশ। জন্ম দিয়ে যদি অবজ্ঞা আর অবহেলার চোখে দেখো! তবে জন্ম দিলে কেন ? ওদের বাঁচতে দাও। ওরা নিষ্পাপ।
যদি আমার মতন হতে তাহলে বুঝতে পারতে। একদিন নীলিমাও গর্ভে ধারণ করেছিল এরকম একটি কন্যা শিশু। সেদিন আমিও তোমাদের মতো অবজ্ঞা করেছিলাম। সেদিন নীলিমাকে আ্যবরশন্ করিয়ে আনি । তারপর আর সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা হয়ে ওঠে নি আমার। কেউ আমাকে বাবা বলে ডাকেনি। নীলিমাও শুনতে পায় নি "মা বলে কেউ তাকে ডাকছে"। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলে রতন। চোখের জল মুছে আবার আ্যলবামের দিকে চোখ ফেরায় সে।
No comments
Post a Comment